পাণ্ডুলিপি প্রেসে দেওয়া মানেই কাজ শেষ নয়; এ আরেক কর্মযজ্ঞের সূচনা!

Posted by on Jun 14, 2021 in Blog | 6 comments

দীর্ঘ ১৩ বছর মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে সম্পৃক্ত আছি। মনে-মনে একধরণের কমপ্লেসেন্স তৈরি হয়েছে। মোটামুটি সব কাজই তো জানি। নতুন করে কিইবা শিখব! হঠাৎ দায়িত্ব পড়ল প্রেসে যাওয়ার, একটি বইয়ের সামগ্রিক কাজ তত্বাবধানের। ভাবলাম, এতো সহজ ব্যাপার! বইটির ডিজাইন হয়ে গেছে। পেশোদার লোক দিয়ে এডিটিং হয়ে গেছে। এখন আর কি এমন কাজ? প্রেস লেআউট করবে, মেকাপ করবে, এই তো, আর কী?

কিন্তু কাজে নেমে দেখলাম, এ এক নতুন কর্মজগৎ। আমাকে দেখতে হলো পৃষ্ঠাগুলোয় শব্দগুলো কীভাবে খাপ খেয়েছে, প্রতি পাতায় সবদিকের মার্জিনগুলো কতটা প্রশস্থ হবে এবং সবপাতায় একই মাপ রয়েছে কিনা, পৃষ্ঠা নম্বর ঠিক আছে কিনা, লেখার ফন্ট কত হবে, কোনটা বোল্ট, কোনটা আইটালিক, কোনটা রেগুলার ইত্যাদি। বইটি সুন্দর দেখায়- এমন প্রতিটি ধাপ স্বযত্নে পার করে চূড়ান্ত কপি হাতে নিয়ে মহাখুশি। তখন কি জানতাম, কাজ তো সবে শুরু!

বইটির নাম ‘‘The other face of Globalisation: COVID-19, the International Labour Migration and the left-behind families of Bangladesh”। আমির খানের ভক্ত হিসেবে পারফেকশনিস্ট শব্দটির সাথে পরিচয় থাকলেও প্রথমবারের মতো বাস্তবের একজন পারফেকশনিস্টের সাথে পরিচয় ঘটল, এ বইটি প্রেস থেকে বের করে আনতে গিয়ে। বইটি প্রস্তুত করে তাসনিম সিদ্দিকী ম্যাডামের হাতে দেওয়ার পরে ভাবলাম, ধন্যবাদ পাবো। কিন্তু একি, পরদিন ম্যাডাম বইটি ফেরত দিলেন ছোট-খাটো বহু ত্রুটি ঠিক করে।

Book Cover

Book Cover

প্রায় একমাস আগে যখন প্রথমবারের মতো বইটি প্রকাশের কাজের সাথে জড়িত হই, প্রথমেই মনে হয়েছিল, এতো-এতো অভিজ্ঞজনেরা ধাপে ধাপে পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন, সেখানে কোনও ভুল নেই। প্রথমবার ডিজাইনের পর বইটি পুনরায় সম্পাদনা করা হয়েছিল, যা ডিজাইনারকে দিয়ে পেইজ সেট-আপ করা হয়েছিল। সেই সাথে মোড়কেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এই ছোট-খাট পরিবর্তনগুলো একটি নিখুঁত বইয়ের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা ধীরে-ধীরে অনুধাবন করেছিলাম।
প্রেস থেকে সফট কপি আনার পর, প্রথম যে চ্যালেঞ্জ এলো- তা হলো, ২২০ পাতার পাণ্ডুলিপির প্রায় প্রতিটি শব্দ জোড়া লাগা! দিশেহারা আমি। লেগে গেলাম জোড়া খুলতে। দুইদিন পর ম্যাডাম ফলো-আপ করে পারভেজ ভাইকে যুক্ত করেন জোড়া খোলার কাজে। মিনিটখানেক পর আমি নতুন ফাইল পাই, যা আমার কাছে ছিল বিস্ময়! অর্থাৎ কম্পিউটারে কোনো প্রোগ্র্যামিং আছে, যা দিয়ে জোড়া লাগা শব্দগুলো আলাদা করে ফেলা যায়। শুধু শুধুই তাহলে দুইদিন প্রাণপাত করেছি? বইয়ের বাইরের মোড়ক, ভেতরের মোড়ক, পেছনের মোড়ক প্রতিটি ক্ষেত্রে কিছু না কিছু ভুল ছিল। খুশি মনে সহকর্মী রাজিব ও রিফার সহায়তায় সব সংশোধন করে প্রিন্ট বের করে ম্যাডামের কাছে পাঠাই। ধরেই নিয়েছিলাম, এবারে দায়িত্ব শেষ! এখন প্রেস তার ছাপার কাজ করবে।

ম্যাডাম সংশোধিত অনুলিপিতে লুকিয়ে থাকা ছোট-ছোট ভুলগুলো কীভাবে যে বের করেন, কে জানে! সে সময় নিজেকে কেমন বোকা-বোকা লেগেছিল। মনে হয়েছিল, কেন এগুলো আমার চোখে ধরা পড়ল না। এবারে আমার সাথে যোগ দিল সহকর্মী রাবাব এবং জাহিদ। সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংশোধিত অনুলিপি ধরে একটা-একটা করে সংশোধন করলাম। স্ব-উদ্যোগী হয়ে প্রতিটা টেবিল ও ফিগার, লাইন ধরে-ধরে চেক করলাম, বাংলা শব্দগুলোকে আইটালিক করলাম এবং অন্যান্য আরও কিছু সংশোধন করলাম। প্রেসে ঠায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে সব পরিবর্তনের কাজ শেষ করলাম।

ম্যাডামের পরবর্তী পর্যালোচনা ছিল অনেকটা চিরুনি অভিযানের মতো। এবারের কাজগুলো ছিল মূলত সফ্টওয়্যারভিত্তিক। বইটির ডিজাইন করার সময় ডিজাইনার বইয়ের কিছু-কিছু শব্দ কোথাও-কোথাও টেনে টেনে লম্বা করেছেন, কোথাও চেপে-চেপে এক লাইনের মধ্যে এঁটেছেন, আবার কিছু শব্দ বিভ্রান্তিকর উপায়ে বিভক্ত হয়ে হাইফেনেটেড হয়ে গেছে। কোথাও-কোথাও শব্দগুলো জোড়া লেগে গেছে। কোনো-কোনো অনুচ্ছেদের প্রথম বা শেষ লাইনটি একটি পৃষ্ঠা বিরতিতে অনুচ্ছেদ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। টেবিল ভেঙে দুই পাতায় চলে গেছে, ইত্যাদি।

মাঝে-মাঝেই হতাশ হয়ে পড়তাম। তখন মেরিনা আপা সাহস যুগিয়েছেন। ম্যাডাম জানালেন, এবারে একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখন রকি আর পারভেজের কাজ। পারভেজ ভাই শব্দ বসিয়ে ফাইন্ড দিয়ে-দিয়ে প্রতিটা শব্দের বিশুদ্ধতা চেক করলেন। খুঁজে-খুঁজে সবগুলো বানান UK spelling কিনা তা দেখলেন। দিন শেষে আবারও সেই সুখানুভূতি। প্রকাশনা কাজের এ পর্যায়ে একেবারে নতুন শিখন- ইনডেক্স তৈরি। ম্যাডাম, ২২০ পাতার বই পর্যালোচনা করে একটা-একটা করে শব্দ চিহ্নিত করলেন আর পারভেজ ভাই পৃষ্ঠা নম্বর খুঁজে বের করে সূচক তৈরি করলেন। পাণ্ডুলিপিটি প্রথমদিকের খসড়া থেকে এখন অনেক পরিণত। আবারও নেয়া হলো প্রিন্ট-আউট। এবারে ঠিক সে মাপের নেওয়া হলো, যে মাপের চূড়ান্ত বইটি প্রকাশিত হবে। উদ্দেশ্য, বইটির চারপাশের মার্জিন ঠিক আছে কিনা তা দেখা। সম্পাদনার প্রতিটি মুহুর্ত বৈচিত্রময়। এই বৈচিত্র্য অত্যন্ত মূল্যবান। ছোট-ছোট ত্রুটিগুলো, যা অগোচরে রয়ে যায়, তা চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নেওয়া থেকে নিজের মাঝে তৈরি হয় অসাধারণ এক অনুভূতি। এককথায়, বইটি যতবার পড়া যাবে ততই নিখুঁত হবে।

কিন্তু হায়, কখন যে প্রেসের লোক সূচিপত্রে গোলমাল করে ফেলেছে, তা কারো চোখে পড়েনি। ম্যাডামের চোখ কিন্তু এড়ালো না, সূচিপত্রের অসমান পংক্তিমালার বিন্যাস। লকডাউনের আগের দিন বিকালে আমরা সবাই ব্যস্ত থাকায় কামাল গেলেন পংক্তিমালার বিন্যাস ঠিক করাতে । সে সময় তার চোখে ধরা পড়ল রামরু’র ভুল টেলিফোন নম্বর!

এবারে ম্যাডামের হাতে বইটির ডামি কপি। এবারের সংশোধনী এলো হলুদ রং-এর বুক মার্কার রিবনটি নিয়ে। সমাপ্ত পণ্যটিতে ত্রুটি সম্পর্কিত এটিও একটি সত্য। বইয়ের বানান বা বিরামচিহ্নের ভুল যদি আপনাকে আঘাত করে, তবে বেমানান রং-এর রিবনটিও পাঠক মনে প্রশ্ন তুলতে পারে। এ রকম ভুলের জন্য পাঠক আপনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবেন। সব ধরণের কাজ শেষে একটি নিখুঁত বই এলো আমাদের হাতে।

লেখক যেমন তার দিক থেকে একটি আকর্ষণীয় পাণ্ডুলিপি দিতে চান, তেমনি প্রকাশনাটি চূড়ান্ত অর্থে আকর্ষণীয় করতে সহায়তা করে টিমওর্য়াক; যা আমাদের ছিল। প্রকাশনা কাজের দলে দরকার শক্ত নেতৃত্বের, যিনি কোথাও ছাড় দেবেন না; যেমন ছিলেন ম্যাডাম। বইয়ের অন্যান্য লেখকরা বইটির জন্য অসাধারণ সব লেখা দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি দেখেছি, বইটি এডিট করতে গিয়ে এর অনেক অংশই ম্যাডাম আবার লিখেছেন এবং সেইসঙ্গে প্রেস থেকে বইটি ছাপা হওয়া পর্যন্ত আমাদের সাথে দিন-রাত কাজ করেছেন। মনে হতে পারে, এসব অতিরিক্ত কাজ। কিন্তু আদতে তা প্রকাশনাটি চিরকালের মতো হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ত্রুটিমুক্ত করার শেষ সুযোগ। খুব ইচ্ছা হচ্ছে, প্রকাশনার সাথে যারা যুক্ত থাকেন- তাদের অভিজ্ঞতা জানার। কেউ আমাদের জানাবেন কি?

The other face of Globalisation: COVID-19, the International Labour Migration and the left-behind families of Bangladesh 

আরিফা আস আলম
প্রকল্প সমন্বয়কারী, রামরু
১৪ জুন ২০২১

6 Comments

  1. অনেক সুন্দর লেখা, পড়ে ভালো লেগেছে। আসলে একটা বই প্রকাশ করা অনেক কঠিন কাজ।

  2. আমি মনে করি, সাহিত্যে ও শিল্পকর্মে যেটা যত বেশি বার্নিস দেওয়া যায় সেটা ততো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। আপা, আপনার এই অনেক বেশি পরিশ্রম আমাদের (পাঠকদের) কাছে বইটি অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছে।


  3. একটি আকর্ষণীয় প্রকাশনা প্রকাশের জন্য টিমওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে| লেখাটা অনেক সুন্দর হয়েছে|

    • This is a inspiration of how to create a perfect publication.

  4. শত কষ্ট আর নিদারুন পরিশ্রমের পরে যখন একটি পূর্নাঙ্গ বই প্রকাশ পায় তখন লেখক ও বই প্রকাশের সকলেই যেন আপ্লুত হয়ে পড়েন। যে কোন প্রকাশনার সাথে মিশে থাকে লেখক ও প্রকাশকের আবেগ।

  5. ২০১৮ সালে প্রকাশিত রামরু’র”অভিবাসীর অকথিত গল্প সপ্ন ও বাস্তবতা” বইটি তে কাজ করার সময় একি রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। এই লেখাটি পরবর্তীকালে কালে যারা প্রকাশনা নিয়ে কাজ করবে তাদের জন্য একটি গাইডলাইন হিসেবে কাজ করবে।