শ্রম অভিবাসন সরাসরি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে যায় ৪.৬% – মেহেদী আল আমিন (প্রথম পর্ব)

Posted by on Jan 17, 2016 in Blog | Comments Off

প্রতি বছর বাড়ছে জনশক্তি রফতানি। তবে বিদেশে যেতে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্টের কাছে সরাসরি পৌঁছতে পারছেন মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিক। বাকিরা দালালের মাধ্যমে এজেন্সিতে যান। এতে বেড়ে যায় তাদের অভিবাসন ব্যয়।

মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার মো. মনির হোসেন। দুই বছর আগে দালালের মাধ্যমে কুয়েত যেতে খরচ করেছেন সাড়ে ৪ লাখ টাকা। গত ডিসেম্বরে দেশে ফিরেছেন এ প্রবাসী শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসে বেতন পেয়েছি ২২ হাজার টাকা। এখনো ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। ছুটিতে এসেছি, আবার গিয়ে ঋণের বাকি টাকা পরিশোধ করে তার পর সঞ্চয়ের কথা ভাবব। আর পরিবারের ভরণপোষণ তো আছেই।’

রিক্রুটিং এজেন্সির কাউকে না চেনার কারণে দালালের শরণাপন্ন হয়েছিলেন বলে হতাশার সঙ্গে জানান এ প্রবাসী শ্রমিক। শুধু মনির নয়, বিদেশ গমনেচ্ছু অধিকাংশ বাংলাদেশী শ্রমিকই বিএমইটি বা বৈধ রিক্রুটিং এজেন্ট সম্পর্কে জানাশোনা না থাকা আর প্রতারিত হওয়ার ভয় থেকে দালালের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এক্ষেত্রে পরিচিতজন অথচ মধ্যস্বত্বভোগীরাই তাদের ভরসা।

সম্প্রতি সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন (এসডিসি) ও রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) যৌথভাবে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘ইমপ্যাক্ট অব মাইগ্রেশন অন পোভার্টি অ্যান্ড লোকাল ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যেতে মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বাংলাদেশী সরাসরি বৈধ সনদপ্রাপ্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কাছে আসেন। বাকি ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশ বিদেশে যান পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, নিজে নিজে বা অন্যান্য উপায়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশটি বিদেশে যাওয়ার জন্য দালালের শরণাপন্ন হয়।

দালালের মাধ্যমে বিদেশে যান ৫২ দশমিক ২ শতাংশ অভিবাসী। বাকিদের মধ্যে নিজের চেষ্টায় ২ দশমিক ১, পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে ১১ দশমিক ৯, আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে ২৪ দশমিক ৯ ও বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে ২ দশমিক ৯ শতাংশ শ্রমিক বিদেশ গমন করেন। এছাড়া কন্ট্রাক্টর ও অন্যান্য মাধ্যমে যায় শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।

ডাটাবেজ থেকে কর্মী সংগ্রহে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে বাধ্য করতে না পারলে সহসাই এ অবস্থার উন্নতি হবে না বলে মনে করেন রামরুর সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. সি আর আবরার। তিনি বলেন, বিএমইটির ডাটাবেজ আরো উন্নত করে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে এজেন্সিগুলো প্রয়োজনীয় কর্মী সেখানে খুঁজে পায়। শুধু উন্নত ডাটাবেজ করলেই হবে না, এজেন্সিগুলোর জন্য এ ডাটাবেজ থেকে কর্মী প্রেরণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, দালাল বর্তমানে একটি বাস্তবতা। এ বাস্তবতা মেনে নিয়েই ভবিষ্যত্ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে। দেশের অনেক জেলা রয়েছে, যেখানে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যায় না। সেখানে দালালই ভরসা। এক্ষেত্রে এজেন্সির অফিসগুলো বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। দালালদের অস্বীকার করে নয়, বরং তাদেরকে একটি নীতিমালার মধ্যে এনে মূলধারায় বৈধতা দেয়ার সময় এসেছে। বিদেশে যাওয়ার আগে কত টাকা দিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন আর সেখানে গিয়ে কত দিনে কত টাকা আয় করা সম্ভব হবে— কোনো সদস্যকে বিদেশে পাঠানোর আগে এ বিষয়গুলো ভেবেচিন্তে পরিবারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অভিবাসী শ্রমিকদের এক বড় অংশ দালালের মাধ্যমে রিক্রুটিং এজেন্সিতে আসার কারণে একধাপ অতিরিক্ত খরচ করতে হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশে যেতে একজন বাংলাদেশী যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন, তার ৫৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। আর ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ অর্থ যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পক্ষে কাজ করেন, এমন ব্যক্তিদের পকেটে। বাকি টাকা ভিসা, টিকিটসহ মূল খাতে ব্যয় হয়।

এক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বেঁধে দেয়া ব্যয়ের চেয়ে যত বেশি নিতে পারবে, তা নিজের পকেটে পুরতে পারবে দালাল। আবার কোনো কোনো এজেন্সি দালালকে জনপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে থাকে। এসব দালালেরও আবার থাকে কয়েকটি স্তর।

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেতে চাইলে একজন বাংলাদেশী শ্রমিকের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ৮৪ হাজার টাকা নিতে পারবে কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি। বিএমইটির ডাটাবেজ থেকে না নিয়ে এবং দালালের মাধ্যমে লোক সংগ্রহ করার ফলে একজন বাংলাদেশীকে বিদেশে পাঠাতে সাড়ে ৩ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে এজেন্সিগুলো, যার এক বড় অংশ যায় দালালের পকেটে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএমইটির ডাটাবেজ থেকে নিবন্ধিত কর্মী পাঠালে সরকার নির্ধারিত খরচের অতিরিক্ত নিতে সমস্যা হয়। তখন কত টাকা নেয়া হচ্ছে, তা বিএমইটি জেনে যেতে পারে। এজন্য অধিক লাভের আশায় রিক্রুটিং ব্যবসায়ীরাও বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মী সংগ্রহে অনেকাংশেই দালালের ওপর নির্ভর হয়ে পড়েছে, ডাটাবেজ থেকে কর্মী সংগ্রহ করছে না। সরকার ডাটাবেজ উন্নত এবং সেখান থেকে নিবন্ধিত কর্মী নিতে এজেন্সিদের বাধ্য করতে না পারার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন এ খাতের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হযরত আলী বলেন, আমাদের একটি সমৃদ্ধ ডাটাবেজ রয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এখান থেকে চাহিদা অনুযায়ী কর্মী সংগ্রহ করতে পারে। অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে দরকষাকষির জন্যই রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো দালালের মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহ করছে। সব দেশে কর্মী পাঠাতে এ ডাটাবেজ থেকে লোক নেয়ার বাধ্যবাধকতা কীভাবে কার্যকর করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছে সরকার। দীর্ঘদিনের একটি ব্যবস্থা বদলাতে কিছুটা সময় লাগে।

তবে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি আবুল বাসার বলেন, সরকারের ডাটাবেজ কোনো কাজের না। আধুনিক ও উন্নত একটি ডাটাবেজ থাকলে তা আমাদের জন্যও ভালো হতো। এজেন্সিগুলো বিদেশে পাঠানোর জন্য লোক চায়। আমরা বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মী খুঁজি। এক্ষেত্রে গ্রামের মানুষের সঙ্গে এজেন্সিগুলোর সেতুবন্ধ তৈরি করে দালালরা। তারা বিএমইটিও বোঝে না, আমাদেরও চেনে না। এখানে দালালদের এক বড় ভূমিকা আছে। সার্বিকভাবে অভিবাসন-সংক্রান্ত সব কার্যক্রম একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত ব্যবসায়িক স্বার্থেই দালাল থাকবে। তবে বিদেশ গমনেচ্ছুদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে— আপনারা সরাসরি এজেন্সিগুলোর কাছে আসুন, দেখে-শুনে আয়-ব্যয় হিসাব করে বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিন।