অনেকদিন পর সাপ্তাহিক ছুটিতে গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়া, গাজীপুর এসেছি। নিস্তার নেই, এখানে বসেই জুমে ‘রামরু স্টাফ কেপাসিটি বিল্ডিং প্রশিক্ষণ’ নিচ্ছি। ফোনটা বেজে উঠল, নুসরাত আপার কল। হন্তদন্ত হয়ে ফিরছি দক্ষিণখানে। অসহায় প্রায় মানসিক ভারসাম্যহীন, নাজনীনকে (ছদ্মনাম) রিফা রিজওয়ান, সামলাতে পারছেন না।
আমাদের অভিবাসী সহায়তা কেন্দ্র, দক্ষিণখানে আসতেই রিফা জানালেন এয়ারপোর্টের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে দিকভ্রান্তের মতো ছুটছিলেন সৌদি আরব ফেরত ত্রিশোর্ধ নাজনীন। চোখে-মুখে অস্থিরতা, আর অনিশ্চয়তা। বিমানবন্দরের ওয়েজ আর্নারস কল্যাণ ডেস্ক থেকে ২১ মে ২০২১, বেলা সাড়ে ১২টার দিকে নিয়ে আসেন তাকে। নাজনীন কিছুতেই সিএনজিতে উঠবেন না, অনেক বলার পরে উঠলেন কিন্তু নামার সময় কোনভাবেই নামবেন না।
“ভাইয়া, অভিবাসী আমার উপর আস্থা রাখতে পারছেন না, কিছুই খাবেন না, বলছেন উনি রোযা। বের হয়ে চলে যেতে চাইছেন বারবার।” রিফা হড়বড় করে একটানা কথা বলতে থাকেন।
“ভাইয়া, অভিবাসী আমার উপর আস্থা রাখতে পারছেন না, কিছুই খাবেন না, বলছেন উনি রোযা। বের হয়ে চলে যেতে চাইছেন বারবার।” রিফা হড়বড় করে একটানা কথা বলতে থাকেন।
আমি নেমে পরলাম কাজে। জেনেছি তিনি বাগেরহাটের। তাই তার মতো করে বললাম, “আপা.., ও আপা.. , আমি এইসেগেছি। আপনার জন্য ইফতার নিয়ে এইসেছি। একটু পরেই তো আযান পরবে। এখন হাত মুখ ধুয়ে খাতি হবে।” কিন্তু, কোনোভাবেই কাজ হচ্ছিল না। আর রিফাকে তো দেখতেই পারছিলেন না।
”তোমারে কিন্তু ফাটাবো।” এবারে কিল দেওয়ার ভঙ্গীতে আমার দিকে তেড়ে আসেন নাজনীন। “আপা আমাকে মারলে আমি যদি মরে যাই, তাহলে আপনাকে নিয়ে যাবে কে? আপা না ভালো, আপনে না আমার আপা।” মনে ভয়, আর আশঙ্কা, কিন্তু মুখে নানা কথার ছলে তাকে শান্ত রাখতে সচেষ্ট থাকি আমরা।
“আমি এখানে থাকবো না, মা পাঠাইছে না তোমারে? তারা নিচে? নাকি আমারে রেখেই চলে গেছে?” কথোপকথনে একরাশ অভিমান। আমার ডেস্কের সামনে চেয়ার টেনে সেখানে বসেই রইলেন ঘন্টার পর ঘন্টা! রাতের খাবারের সময় আরেক সমস্যা। হঠাৎ করে নাজনীন এর মনে হলো খাবারে ওষুধ মেশানো আছে। আর সে খাবার খেল না। এরইমধ্যে তিনি আমাকে তার স্বামী নসু মিয়া (ছদ্মনাম) ভাবতে শুরু করেছেন।
”তোমারে কিন্তু ফাটাবো।” এবারে কিল দেওয়ার ভঙ্গীতে আমার দিকে তেড়ে আসেন নাজনীন। “আপা আমাকে মারলে আমি যদি মরে যাই, তাহলে আপনাকে নিয়ে যাবে কে? আপা না ভালো, আপনে না আমার আপা।” মনে ভয়, আর আশঙ্কা, কিন্তু মুখে নানা কথার ছলে তাকে শান্ত রাখতে সচেষ্ট থাকি আমরা।
“আমি এখানে থাকবো না, মা পাঠাইছে না তোমারে? তারা নিচে? নাকি আমারে রেখেই চলে গেছে?” কথোপকথনে একরাশ অভিমান। আমার ডেস্কের সামনে চেয়ার টেনে সেখানে বসেই রইলেন ঘন্টার পর ঘন্টা! রাতের খাবারের সময় আরেক সমস্যা। হঠাৎ করে নাজনীন এর মনে হলো খাবারে ওষুধ মেশানো আছে। আর সে খাবার খেল না। এরইমধ্যে তিনি আমাকে তার স্বামী নসু মিয়া (ছদ্মনাম) ভাবতে শুরু করেছেন।
ভোররাতে উঠে নাজনীন অফিসের সব কাগজপত্র ছুড়তে শুরু করলেন। রিফাকে মারতে চাইলেন। এভাবেই সেই রাতটা কেটেছিল। পরদিন সকালে অফিসে আসলে নাজনীন এর প্রশ্ন, “সারারাত কোথায় ছিলে গো, কি খেয়েছো? এরকম হাজারো অভিমান ভরা প্রশ্ন ছিল নাজনীন এর চোখে-মুখে।
যতক্ষণ আমি আছি ততক্ষণ তিনি ভাল থাকতেন, বাকিটা সময় শুধু ছটফট। সেন্টার থেকে তাকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নেই, লিগ্যাল গার্ডিয়ান না থাকায় ভর্তি করা গেল না। আউট পেশেন্ট হিসেবেই চিকিৎসা চলল। পাশাপাশি খোঁজতে লাগলাম তার পরিবার।
যতক্ষণ আমি আছি ততক্ষণ তিনি ভাল থাকতেন, বাকিটা সময় শুধু ছটফট। সেন্টার থেকে তাকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নেই, লিগ্যাল গার্ডিয়ান না থাকায় ভর্তি করা গেল না। আউট পেশেন্ট হিসেবেই চিকিৎসা চলল। পাশাপাশি খোঁজতে লাগলাম তার পরিবার।
বিকাল থেকে রামরু হেড অফিসের নুসরাত আপা আর আমি অনবরত তার এলাকার থানায় ফোন দিতে থাকলাম। তথ্য বাতায়ন ওয়েবসাইট থেকে ফকিরহাট থানার কয়েকজন গ্রাম পুলিশের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করি। দুই জনের কাছে ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়জন নাজনীন এর গ্রামের গ্রামপুলিশের নাম্বার দেয়। তার সাথে যোগাযোগ করতে করতে রাত অনেক হয়ে গেল। তিনি পরদিন ভোরবেলায় কথা বলিয়ে দেন নাজনীন এর ছেলে আশিকের (ছদ্মনাম) সাথে।আশিক, নাজনীন এর প্রথম সংসারের ছেলে। স্থানীয় কাঠের ফার্নিচারের দোকানে কাজ করে। বিয়ের দশ বছর পর নাজনীন এর স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। নাজনীন আবার বিয়ে করেন সেখানে তার একটি কন্যা সন্তান হয়। দ্বিতীয় বিয়ের দুই বছর পর তার দ্বিতীয় স্বামী তাকে ছেড়ে দেয়। তারপর মেয়ে নিয়ে ছেলের কাছেই থাকেন নাজনীন। অভাব অনটন কাটাতে বিদেশ গিয়েছিলেন। প্রথম অভিবাসনের অভিজ্ঞতা ভালো হলেও দ্বিতীয় অভিবাসন তাকে নিঃশেষ করে দেয়।
আশিক তো মায়ের গলা শুনে দিশেহারা! তখনই রওনা দিয়ে বিকেল নাগাদ এসে পৌঁছল রামরুর দক্ষিণখান অভিবাসী সেবা কেন্দ্রে। চিকিৎসায় কিছুটা স্থিতি চলে আসছিল নাজনীন এর। ছেলেকে দেখে তার কান্নার বাঁধ যেন ভেঙ্গে পরল। অবিশ্বাস আর অনিশ্চয়তার ছাপ মুখ থেকে একনিমিশে উবে গেল।
আজ আরেক ছুটির দিন। বসে বসে ভাবছিলাম নাজনীনের কথাই। রামরুতে কাজ করবার সুবাদে এমন কত নাজনীনকেই যে তার ঠিকানায় ফিরিয়ে দিলাম। আমার জন্য এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে।
রাজিব ঘোষ, প্রকল্প কর্মকর্তা, রামরুআশিক তো মায়ের গলা শুনে দিশেহারা! তখনই রওনা দিয়ে বিকেল নাগাদ এসে পৌঁছল রামরুর দক্ষিণখান অভিবাসী সেবা কেন্দ্রে। চিকিৎসায় কিছুটা স্থিতি চলে আসছিল নাজনীন এর। ছেলেকে দেখে তার কান্নার বাঁধ যেন ভেঙ্গে পরল। অবিশ্বাস আর অনিশ্চয়তার ছাপ মুখ থেকে একনিমিশে উবে গেল।
আজ আরেক ছুটির দিন। বসে বসে ভাবছিলাম নাজনীনের কথাই। রামরুতে কাজ করবার সুবাদে এমন কত নাজনীনকেই যে তার ঠিকানায় ফিরিয়ে দিলাম। আমার জন্য এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে।
৩১/০৫/২০২১
হৃদয়স্পর্শী কাহিনী
প্রথম দুই বছর ভালো ছিলো তার প্রবাস জীবন। পরবর্তীতে আবার বিদেশ গেলে দুই বছরের নির্যাতনের দরুন তাকে একজন পাগল হয়েই ফিরে আসতে হলো স্বদেশে। কে নিবে এই দ্বায় ??
Uni bidesh gesen buk bhora asha niye ar fire eshen pagol hoye. Ai dai amader sobar.
মর্মস্পর্শী কাহিনি।
সত্যিকার অর্থে এইসব ঘটনা আগে অবাস্তব মনে করতাম. কিন্তু এখন এই বাস্তব ঘটনা শুনে আমি জাস্ট অবাক হয়ে গেলাম. বেঁচে থাকুক মনুষত্ব, বেঁচে থাকুক রামরু
নাজনীনের মত অনেক নারী অভিবাসীর রয়েছে হৃদয়স্পর্শী কাহিনী। যা শুধুমাত্র ভুক্তভোগী নারীই বয়ে বেড়ান।
কতটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেলে একজন মানুষ মানসিকভাবে এতটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে !
এমন হ্রদয় বিদারক অনেক কাহিনী আছে যাহা সবার অজানা এমনকি কেহ জানতেও চায়না,সমাজে নারীরা সংসারের একটু সুখের জন্য নিজের দিকটার কথা ও ভুলে যায় এমন এক চরিত্র হল নাজনীন। সমাজে ও পরিবারে নারীর ভুমিকা যে কম নয় তাহা নাজনীন এর অবস্থার কথা উপলব্দি করলেই বোঝা যায়-এ দেশের হাজারো প্রবাসী নারীর জীবন দশার প্রতিক হল এই নাজনীন। প্রবাসী নাজনীনদের এমন করুন অবস্থার জন্য দায়ী কে বা কারা?এর প্রতিকারই বা কি?
এমন আরো শত শত সোনালী যোদ্ধা আপাদের কথা উঠে আসুক রামরুর মাধ্যমে।
আসলেই এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই নেই। একজন দিশেহারা মানুষকে তার গন্তব্য খুঁজে সেখানে নিরাপত্তার সাথে পৌঁছে দএয়ার মতো মহৎ কয়াজ করেছেন আপনারা। আপনাদের জন্য অনেক শুভকামনা। সবাই তো মুখে বলে শুধু কিন্তু রামরু যে কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী এই কথাগুলোই তার জলন্ত প্রমান।
আমরা চাই এভাবেই পথভ্রষ্ট অভিবাসীরা রামরুর হাত ধরেই আবার নতুন জীবন খুঁজে পাক।
আসলেই এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই নেই। একজন দিশেহারা মানুষকে তার গন্তব্য খুঁজে সেখানে নিরাপত্তার সাথে পৌঁছে দেয়ার মতো মহৎ কাজ করেছেন আপনারা। আপনাদের জন্য অনেক শুভকামনা। সবাই তো মুখে বলে শুধু কিন্তু রামরু যে কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী এই কথাগুলোই তার জলন্ত প্রমান।
আমরা চাই এভাবেই পথভ্রষ্ট অভিবাসীরা রামরুর হাত ধরেই আবার নতুন জীবন খুঁজে পাক।