অভিবাসী শ্রমিক প্রেরিত অর্থের মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে

Posted by on Dec 20, 2015 in Blog | Comments Off

অভিবাসী শ্রমিক প্রেরিত অর্থের মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে

মো. সেলিম রেজা ও সি আর আবরার

আজ আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। এ বছর দিবসটি প্রতিপালনে বছরজুড়ে চলতে থাকা অভিবাসী ও শরণার্থী সংকটকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে অভিবাসনপ্রত্যাশী লোকজনের নির্মম মৃত্যুর ঘটনা বিশেষ গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, উন্নত দেশে অভিবাসনের জন্য অবৈধ উপায়ে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হন, তাদের কথা বিশেষ বিবেচনায় নেয়ার কথা বলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া। সাম্প্রতিক কালে সমুদ্রপথে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। একদিকে পরিস্থিতির চাপে পড়ে একদল মানুষ উন্নত জীবনের আশায় ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে চায়, অন্যদিকে উন্নত দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা ও আইনি জটিলতার অজুহাতে সেসব মানুষকে আশ্রয় না দেয়ার প্রচেষ্টা চালায়। এটি আদৌ কোনো সংকট নাকি বড় সমস্যা, তা নিয়ে এখনো মতবিরোধ রয়েছে। অভিবাসী ও শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় উন্নত দেশগুলোর দায়িত্ব নিয়েও নানা বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ সরাসরি এ সমস্যার অংশ নয়। তবে শ্রমিক প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রয়েছে অন্য অনেক রকমের প্রতিবন্ধকতা। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকের পাঠানো অর্থের অবমূল্যায়ন তথা কম বিনিময় হার।

বিদেশ থেকে বাংলাদেশে পাঠানো অর্থ তথা রেমিট্যান্সের বিনিময় হার বর্তমান সময়ে বিদেশে অবস্থানরত কর্মীদের জন্য একটি হতাশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে প্রায় এক বছর ধরে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে টাকা পাঠাতে গেলে যে বিনিময় হার পাওয়া যায়, তা খুবই কম। রাত-দিন পরিশ্রম করে শ্রমিকরা বিদেশে যে অর্থ উপার্জন করেন, তা এখন দেশে পাঠাতে গেলে অনেক কম টাকা পাওয়া যায়। এখনো হুন্ডি ব্যবসাকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করা সম্ভব হয়নি, তার ওপর হতাশাজনক বিনিময় হার বা এক্সচেঞ্জ রেট অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোকে উত্সাহিত করছে। এত কিছুর পরেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে এবং বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, মুদ্রার বিনিময় হার অসন্তোষজনক হওয়া সত্ত্বেও প্রবাসী শ্রমিকরা এত রেমিট্যান্স কেন পাঠাচ্ছেন? আসলে রেমিট্যান্স প্রেরণ এবং এ-সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত একটি জটিল প্রক্রিয়া। বাস্তবতা হলো, বিনিময় হার হতাশাজনক জেনেও বহু শ্রমিক প্রতিদিন দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। এর পেছনে মূলত দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। প্রথমত. বাংলাদেশ থেকে পাঠানো শ্রমিকের এক বড় অংশ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন তাদের নিজ পরিবার ও পরিজনের দৈনন্দিন খরচাদি হিসেবে। অর্থাত্ বিদেশে অবস্থান করলেও অনেক শ্রমিককে দেশে তার পরিবার-পরিজনের খরচ বহন করতে হয়। এসব প্রবাসী শ্রমিককে বিনিময় হার যা-ই হোক না কেন, নানা কারণে পরিবারের কাছে নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠাতে হয়। দ্বিতীয়ত. বাংলাদেশ থেকে যেসব শ্রমিক বিদেশ যান, তাদের বেশির ভাগের বিদেশে অর্থ সঞ্চয় বা জমা রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। বিদেশে নিজের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা উপার্জিত অর্থ নিজের কাছে দীর্ঘদিন জমা রাখার মতো কোনো সুবিধা নেই। অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিদেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা যেমন একটি দুঃসাধ্য কাজ, তেমনি অভিবাসী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র ও বাসস্থান কোনোটাই নগদ অর্থ জমা রাখার জন্য নিরাপদ নয়। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা বাধ্য হয়ে দেশে টাকা পাঠাতে গিয়ে কম বিনিময় হার পেয়ে শ্রমিকরা হতাশ হচ্ছেন।

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার-সংক্রান্ত হতাশা একজন অভিবাসী শ্রমিকের কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা না বললেই নয়। বেশ কিছুদিন আগে কুয়ালালামপুরে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকদের ওপর এক গবেষণার কাজে আমরা মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম। বাংলাদেশী শ্রমিকরা যেসব এক্সচেঞ্জ হাউজ ও ব্যাংক শাখা থেকে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান, তার বেশ কয়েকটিতে আমরা সারা দিন বসে থেকে সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও অভিবাসী কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। বাংলাদেশী শ্রমিকদের কাছে সেখানকার সবচেয়ে বড় এক্সচেঞ্জ হাউজ হলো মার্চেন্ট্রেড। আর মার্চেন্ট্রেডের কোতারায়া শাখায় রেমিট্যান্স পাঠাতে এসে সেদিনের বিনিময় হার দেখে এক শ্রমিক হতাশা আর ক্ষোভে আমাদের জানালেন যে, তিন মাস ধরে তিনি বাড়িতে টাকা পাঠাতে গিয়ে কম বিনিময় হার পাচ্ছেন। রিঙ্গিতের বিপরীতে বাংলাদেশী টাকার মান বেড়ে যাওয়ার ফলে তার পরিবার আগের তুলনায় এখন কম টাকা পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, এর আগে মালয়েশিয়া থেকে তিনি ১ রিঙ্গিত পাঠালে বাংলাদেশে তার পরিবার ২৫ টাকা পেত, কিন্তু এখন ১৮ টাকার বেশি পায় না। এ অবস্থা চলতে থাকলে তিনি বাড়িতে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়ে দেশে ফেরত যাবেন বলে হতাশা প্রকাশ করলেন। মালিককে বেতন বাড়ানোর কথা বলতে গিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হয়ে কয়েক দিন আগে তিনি কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। তার ব্যক্তিগত ধারণা, বাংলাদেশী টাকায় মালয়েশিয়ান রিঙ্গিতের বিনিময় হার কম হওয়ার কারণে তার মতো বহু শ্রমিক হতাশায় পড়ে বিকল্প চিন্তা করছেন। মালয়েশিয়ায় আমরা দেখেছিলাম, প্রতিদিন বিশেষ করে ছুটির দিনে বহু শ্রমিক সকাল থেকে এক্সচেঞ্জ হাউজের সামনে ভিড় করা শুরু করেন। সারা দিন ধরে এক্সচেঞ্জ রেট ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থেকে দেশে টাকা না পাঠিয়ে দিনশেষে ফিরে যান অনেক শ্রমিক। সারা দিনের ওঠানামা দেখে সামনের সপ্তাহে বিনিময় হার খানিকটা বাড়তে পারে— এমন আশা বুকে নিয়ে ফিরে যান তারা। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এমন পরিস্থিতি সত্যি হতাশাজনক।

একজন অভিবাসী শ্রমিককে যখন নিজের উপার্জিত অর্থের বিনিময় হার এবং সে-সংশ্লিষ্ট অস্থিতিশীলতা নিয়ে ভাবতে হয়, তখন তার ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয়। আর সে মনস্তাত্ত্বিক চাপ ছড়িয়ে পড়ে নিজ পরিবারসহ সবখানে। মানসিক চাপের কারণে কাজের প্রতি উদাসীনতা তৈরি হয় এবং এর ফলে কাজের দক্ষতা ও মান হ্রাস পায়। দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যগত সমস্যাও দেখা দেয়। সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো, এই হতাশা বেশি দিন চলতে থাকলে শ্রমিকদের মধ্যে মাদকাসক্তি ছড়িয়ে পড়তে পারে। অর্থাত্ এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে সামগ্রিকভাবে শ্রমিক, তার পরিবার ও সমাজ, গ্রহণকারী দেশ ও প্রেরণকারী দেশ— সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে যখন বিভিন্ন দেশে কর্মী পাঠাতে গিয়ে বাংলাদেশ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, তখন দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা কম বিনিময় হারের কারণে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে। কয়েক মাস ধরে দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে অভিবাসী কর্মীদের স্বাচ্ছন্দ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা সবাই জানি, মুক্ত বাজার অর্থনীতির বিশ্বে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত হয় বাজারে মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের পারস্পরিক ক্রিয়ায়। মুদ্রানীতিসহ সংশ্লিষ্ট অন্য অনেক জটিল বিষয়াদিও রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ণয়ের সেসব জটিল হিসাব-নিকাশের অনেকটাই অভিবাসী শ্রমিকের জানা নেই, থাকার কথাও নয়। একজন অভিবাসী শ্রমিকের কাছে তার উপার্জিত অর্থের সঠিক মূল্যায়ন সবচেয়ে জরুরি বিষয়। পরিবার-পরিজন ফেলে বিদেশের মাটিতে দিন-রাত অমানবিক পরিশ্রম করে মাসশেষে বৈদেশিক মুদ্রায় যে মজুরি হাতে আসে, তার ভালো বিনিময় হার পেলেই তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হন। এর বিপরীত ঘটলেই খুব স্বাভাবিকভাবে তিনি হতাশায় ও ক্ষোভে প্রশ্ন করে বসেন, ‘আমার দেশের সরকারের কি কিছুই করার নেই?’

বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার চলমান বিনিময় হার এবং এ-সংক্রান্ত সরকারি পদক্ষেপ এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমান সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে উত্সাহ দিয়ে আসছে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) অনেক দিন ধরে ব্যাপক প্রচারণা করে আসছে। এরই মধ্যে অনেক সুফল চোখে পড়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বৈধ-অবৈধ বিতর্কের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অভিবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্সের বিনিময় হার। বিষয়টি নিয়ে খুব দ্রুত সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সরকারের নীতি প্রণয়নকারী বিভাগগুলো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর সমন্বয়ের মাধ্যমে শুধু অভিবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ বিনিময় হার প্রদান করা সম্ভব কিনা, তা যাচাই-বাছাই করে দেখা যেতে পারে। এছাড়া নিয়মিত রেমিট্যান্স প্রেরণকারী অভিবাসী কর্মীদের জন্য বিশেষ ছাড় বিবেচনা করা যেতে পারে। সেটা হতে পারে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্সভিত্তিক সঞ্চয় ও মুনাফা উত্সাহিত করার লক্ষ্যে নতুন নতুন সেবা তৈরি করতে হবে। মোটকথা, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য অভিবাসন একটি সম্ভাবনাময় এবং সবসময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাত। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজি অর্জনে অভিবাসন তথা রেমিট্যান্সের ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও রেমিট্যান্সের মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যে অভিবাসন খাত বিশেষভাবে তাত্পর্যপূর্ণ। তাই অভিবাসী কর্মী পাঠিয়ে শুধু সংখ্যাগত দিক নিয়ে গর্ব করলেই চলবে না। বিদেশে অবস্থানরত কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। আকর্ষণীয় বিনিময় হার প্রদান করে অভিবাসী কর্মীদের কষ্টার্জিত অর্থের সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

লেখকদ্বয় যথাক্রমে রামরুর গবেষক ও অস্ট্রেলিয়ার ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডিরত
রামরুর সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক

প্রকাশিতঃ বণিক বার্তা
তারিখঃ ১৮/১২/২০১৫