উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে প্রবাসী পরিবারগুলো ( তৃতীয় পর্ব )

Posted by on Jan 17, 2016 in Blog | Comments Off

উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে প্রবাসী পরিবারগুলো

মেহেদী আল আমিন

অভাবের তাড়না কিংবা বেশি উপার্জনের আশায় শ্রম বিক্রি করতে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছেন বাংলাদেশের শ্রমিকরা। পাশাপাশি দেশের ভেতরেও কয়েক লাখ শ্রমিক অভিবাসন করছেন। দেশের উন্নয়নে উভয় ধরনের শ্রমিক যথেষ্ট অবদান রাখলেও তাদের পরিবারের সদস্যরা পিছিয়ে পড়ছে উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরে অভিবাসিত শ্রমিকদের তুলনায় প্রবাসী শ্রমিকের পরিবারের সদস্যরা উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে বেশি। উভয় ধরনের পরিবারের নারী সদস্যরা এক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে সবচেয়ে বেশি।

সম্প্রতি সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন (এসডিসি) ও রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) যৌথভাবে অভ্যন্তরীণ অভিবাসী ও প্রবাসী শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের আঞ্চলিক দারিদ্র্য ও স্থানীয় উন্নয়নের ওপর অভিবাসনের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘ইমপ্যাক্ট অব মাইগ্রেশন অন পভার্টি অ্যান্ড লোকাল ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরিতে দেশের সাতটি বিভাগের ১৮টি জেলার মোট ৫ হাজার ৮৪টি পরিবার থেকে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। এতে অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোর মধ্যে প্রবাসী ২ হাজার ৪৬৬, অভ্যন্তরীণ অভিবাসী ১ হাজার ৩৯০ ও কোনো সদস্য অভিবাসন করেনি, এমন পরিবার ছিল ১ হাজার ২২৮টি। প্রবাসী ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসী পরিবারের সদস্যদের উচ্চশিক্ষায় অনাগ্রহের পেছনে পড়াশোনা শেষে দেশে চাকরি পাওয়া-বিষয়ক অনিশ্চয়তার তথ্য গবেষণাটিতে উঠে এসেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রবাসী শ্রমিকের পরিবারে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ সদস্যের। এর মধ্যে দশমিক ৬ শতাংশ পুরুষ। নারীদের মধ্যে এ হার আরো কম। এসব পরিবারের মাত্র দশমিক ২ শতাংশ নারী এ পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণ করছে। পক্ষান্তরে অভ্যন্তরীণ অভিবাসী শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ১ শতাংশের রয়েছে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। এর মধ্যে পুরুষ ১ দশমিক ৫ শতাংশ। আর নারী সদস্যদের মধ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে দশমিক ৪ শতাংশের। অভ্যন্তরীণ অভিবাসী শ্রমিক পরিবারগুলোর তুলনায় প্রবাসী পরিবারগুলোয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে অর্ধেকেরও কম।

একইভাবে প্রবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে স্নাতক ডিগ্রি রয়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ সদস্যের। এর মধ্যে পুরুষ ২ দশমিক ১ ও নারী ১ শতাংশ। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ অভিবাসী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্নাতক ডিগ্রি রয়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশের। এর মধ্যে পুরুষ ৪ দশমিক ১ ও নারী ১ দশমিক ৩ শতাংশ।

স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় ক্ষেত্রেই অভ্যন্তরীণ অভিবাসী পরিবারের সদস্যদের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে প্রবাসী পরিবারগুলোর সদস্যরা। এজন্য দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ও শিক্ষার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এতে দেখা গেছে, পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিভিন্ন কারিগরি কাজে যুক্ত হচ্ছেন প্রবাসী পরিবারের সদস্যরা। উদ্দেশ্য বিদেশে চাহিদা আছে, এমন কাজ শিখে গিয়ে অধিক বেতনে চাকরি করা। কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মো. হাফিজ শেখের পরিবার এমনই একটি পরিবার। চার বছর ধরে সৌদি আরবের একটি কারখানায় কাজ করছেন হাফিজ। তার ছেলে মো. আজিজ শেখ ২০১৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরিবর্তে সম্প্রতি তিনি গাড়ি চালনা শিখতে ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছেন। গাড়ি চালাতে পারলে সৌদি আরবে প্রতি মাসে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়। তাই বাবার সিদ্ধান্তেই গাড়ি চালনা শিখছেন আজিজ। চালকের সনদ পেলেই সৌদি আরবে যাবেন তিনি। সেক্ষেত্রে ভিসার ব্যবস্থা করবেন তার বাবা।

মো. আজিজ বলেন, পড়াশোনা শেষ হবে কবে আর চাকরিইবা পাব কবে। চাকরি পেলেইবা কত টাকা কামাই করতে পারব। বাবা বলছে, ড্রাইভিং শিখে সৌদি যেতে পারলে জীবনে কিছু করতে পারব, অভাব থাকবে না।

এ বিষয়ে রামরুর সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সিআর আবরার বলেন, ডিগ্রি দিয়ে বাজারে চাকরির সুযোগ কম। যেসব পরিবারের কর্তাব্যক্তি বেশি দিন বিদেশে থাকেন, যোগাযোগের অভাবে তাদের সামাজিক মূলধন (সামাজিক পরিচিতি) কমে যায়। তাই তারা শুধু ডিগ্রি অর্জনের ওপরই সন্তানের চাকরির ভরসা রাখতে পারেন না। এ অবস্থায় তাদের সন্তানদের অল্প বয়সেই বিদেশে নিয়ে যেতে চান তারা। তবে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করার একটা ঝোঁক এসব পরিবারের মধ্যে লক্ষণীয়।

তিনি বলেন, বিদেশে চাহিদা রয়েছে— এমন বিভিন্ন ধরনের কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। উচ্চশিক্ষার পরিবর্তে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অধিক অর্থ উপার্জন দেশের জন্য ভালো।

প্রবাসী পরিবারগুলোয় উচ্চশিক্ষার হার কম হওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হযরত আলী বলেন, আমরা চাই ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শেষ করেই বিদেশে যাক; তাহলে ভালো চাকরি পাবে। তবে কারিগরি শিক্ষাকেও গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। যে পরিবারগুলোর সদস্য আর্থিক অনটনের কারণে বিদেশে চলে যায়, তাদের কাছে পড়াশোনা আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করছি তারা যাতে কারিগরি কোনো দক্ষতা অর্জন করে বিদেশে যেতে পারেন।

উল্লেখ্য, গবেষণায় শ্রম বিক্রি করতে অন্তত তিন মাস বাড়ির বাইরে থাকা ব্যক্তিদের অভ্যন্তরীণ অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আর এক বছরের বেশি সময় ধরে বিদেশে অবস্থান করলে তাকে প্রবাসী শ্রমিক বিবেচনা করা হয়েছে। যেসব জেলার পরিবারের তথ্য গবেষণাটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে সেগুলো হলো— চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল, লক্ষ্মীপুর, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, সুনামগঞ্জ, বরিশাল, কুষ্টিয়া, শরীয়তপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, খাগড়াছড়ি ও রংপুর।